পরিচিতি

জগতের যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ খুব সম্ভবত নিজের ইন্ট্রোডাকশান দেওয়া। আমি কে , আমি কী এর উত্তর দেওয়ার থেকে কঠিন কাজ নেই। আমার এই পুঁচকে ব্লগের বয়স খুব বেশিদিন না  এবং আদৌ কেউ এই ব্লগ পড়ে কিনা সে নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে , তাও  নিজের পরিচিতিটা দেওয়া উচিত, তা সে যত কঠিন কাজ ই হোক না কেন।  তাহলে শুরু করা যাক...... আমার নামঃ  -আমার ভাল নাম সেঁজুতি , ইংরিজিতে বানান বিভ্রাটে বেশির ভাগ লোকের কাছে আমি সেঞ্জুতি  , তাই আমার ডাক নামটা আমার বেশি পছন্দের, সেটা হোল ঝিল্লী, এই নামটা আমার দিদার দেওয়া। ট্যাঁ ট্যাঁ  করে সারাদিন চিৎকার করতাম বলে হয়ত।  আমি কী করি? -এটার উত্তর দেওয়া সবচাইতে সহজ। আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। আমার বয়স কত? - আমার জন্ম নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। বাকিটা আর বললাম না।  আমার ঠিকানা -কেন এই তো - http://choshmaebongityadi.blogspot.in  তবে আমি যেখানে 'থাকি' সে জায়গাটা হোল কোলকাতা। রিলেশানশিপ স্ট্যাটাস   - টারমিনালি সিঙ্গেল  রিলিজিয়াস ভিউস   - কি সব্বনাশের প্রশ্ন !  আমার কী ভালো লাগে? -হেহ! সুপার হিরো কমিক্স (বিশেষত হারলি কুইন এ

ছড়ানোর শেষবেলা

শেষ পর্ব
৬. 'হাতি মেরে সাথী'
লাটাগুড়িতে শেষ দিন আজ।হোটেলে ফিরে কোনমতে হুড়মুড় করে রেডি হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বক্সার দিকে। জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়, বাজার, ফের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যখন দূর্গাপ্রসাদ অধিকারীর বাড়িতে পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর দুটো। বক্সায় হোটেল বলতে তেমন নেই, সবই হোম স্টে। চারদিকে পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে অল্প একটু সমতল জায়গায় গুটিকয়েক বাড়ি নিয়ে গোটা গ্রামটা। কাঠের খুঁটির ওপর বাড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই টানা বারান্দা। সেখানে দেখি তিনজন পুঁচকে একটা ব্যাট বল নিয়ে বেজায় ব্যস্ত, আর তাদের বড় দিদি সব তদারক করছে। সবচেয়ে ছোটজনের বয়স দুই, আর তার বড় দুজনের আট, আর সবচেয়ে বড়জন রিটার বয়স চোদ্দ। খুদেটির নাম ঋষি, ভাব করার চেষ্টা করতে গেছিলাম, সে দুবার যা যা, আর  না না বলে ব্যাট হাতে দৌড় দিলো একটা,আর বড় দুজন, শুভ আর শর্মিলা, ভাইয়ের এরকম ব্যবহারে বেশ বিরক্ত হয়ে তাকে ধরার জন্য পেছন পেছন দৌড়ে রান্নাঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর রিটাও আমাদের দেখে তড়িঘড়ি আসুন বসুন বলে আমাদের ব্যাগ পত্র টানতে শুরু করলো। ভাবখানা পাকা গিন্নির মতন। স্কুল ছুটি চলছে কিনা, অতএব সব দায়িত্ব তো তারই। আর  অমন একটা বাচ্চা মেয়ে অতবড় স্যুটকেস টানতে যাওয়ায় আমরা নিজেরাই অপ্রস্তুত হয়ে টেনেটুনে ঘরের ভেতর মালপত্র এনে মেঝেতে ফেললাম। বাড়িটা ভারী সুন্দর। পেছনে বেতের ঘেরা বারান্দা আর তার পেছনেই জঙ্গল। বিকেলে গেলাম জয়ন্তী নদীর ধারে। জল বেশি নেই, তবে স্রোত সাংঘাতিক। ধূসর বালি, আর পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে রোদ মাখা পাহাড়ের দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে ছিলাম। পায়ের ওপর দিয়ে ঠান্ডা জল চলে যাচ্ছে, গত কয়েকদিনের স‍্যাঁত সেঁতে  আবহাওয়া আধা রোদ আধা ঠান্ডায় বদলে গেছে।

 ফিরছি যখন সুর্য্যও দেখলাম টাটা বাই বাই বলে বাড়ি ফিরছেন।


হোটেলে ফিরে সবাই মোটামুটি ঘরে চাদরের তলায় ঢুকে পরল। আমি আর মাসিমনি বেশ কিছুক্ষন বারান্দায় বসে ছিলাম। একটা ময়ূর এক গাছ থেকে আরেক গেছে লাফ দিয়ে চলে গেল। সামনের রাস্তা দিয়ে লাইন দিয়ে গরুর দল বাড়ি ফিরছে, আবছা অন্ধকারে তাদের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে না তেমন, তবে গলার ঘন্টার ঠুঙ ঠাং আওয়াজ জঙ্গলের পোকামাকড়ের আওয়াজকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার।

 রিটা বলেছিল, প্রায়ই নাকি হরিণ আর হাতি আসে ওই রাস্তায়।সেই আশাতেই ছিলাম। কিন্তু সারাদিন পর ক্লান্তও লাগছিল আর অন্ধকারে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর  মশার কামড় আর রিনটিনদির কাঁই মাই নিতে না পেরে ভেতরে ঢুকে দেখি সামনের বারান্দায় শুভ আর শর্মিলা চেয়ার পেতে বসে টিভি দেখছে। উঁকি মারতে দেখি আল্লু অর্জুন সাদা লুঙ্গি শক্ত করে কোমরে বেঁধে কোন এক ভিলেনকে মেরে পাটপাট করে দিচ্ছেন। দেখলেই গায়ে কাঁটা দেয়। ওসব ছেড়ে লেপের তলায় ঢোকা যায় নাকি! আমরা দুজনও চেয়ার নিয়ে বসে গেলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, হিরো ততক্ষনে নায়িকার বাবাকে কনভিন্স করে ফেলেছেন, গ্রামের সবাই ও চিয়ার করে গলা ব্যাথা করে ফেলেছে, এমত অবস্থায় হুট করে সিনেমাটা শেষ হয়ে যাওয়ারই কথা। পরের সিনেমামার সাথে আলাপ করতে গেছিলাম। শুরুতেই একজন এক ঘুঁষি মেরে একটা দাঁতাল হাতিকে কব্জা করে ফেলেছেন দেখে বাচ্চা পার্টির ছোটা ভীমের রিকোয়েস্ট ক্যানসেল করে আমরা গুছিয়ে বসেও ছিলাম তবে আচমকা হিরো মশাই তাঁর স্বল্পবসনা হিরোইনকে এমন চুমু টুমু খেতে শুরু করলেন যে আমরাও বাধ্য হয়ে 'ইয়ে শুভ, তোরা ওই কৃষ্ণা আর ছোটা ভীম চালা বুঝলি' বলে কেটে পড়লাম। 
রাতে যখন ফাইনালি ঠান্ডায় গুটি শুটি মেরে শুতে যাচ্ছি, বাইরে তাকিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় পুরো পাহাড় গুলো মাখামাখি হয়ে স্নান করছে।
৭. 'এ দুনিয়া...এ দুনিয়া বঢ়ি গোল হ্যায়'
বক্সাতে একরাত কাটিয়ে পরদিন সকালবেলা ঋষি, রিটা, শুভ, শর্মিলা আর জয়ন্তী নদীকে টাটা করে  আমরা রওনা হলাম ভূটানের দিকে, গন্তব্য ফুন্টসেলিং। আর আমরা চলে যাচ্ছি দেখে এবার ঋষিও এসে টাটা করে গেল। এদিকে সারা সকাল হা পিত‍্যেশ করেও একটা হরিণ আর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। ফিরতি পথে গাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা এগোতে দেখি বিল বোর্ড, হেডিং সব উপড়ানো, গাছপালা লন্ডভন্ড।  গাড়ির আয়নায় চোখ পড়তে দেখি, ড্রাইভার সাহেবের মুখ লাল, নাকের পাটা অল্প অল্প ফুলছে, ডানদিকে জঙ্গলের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে কী একটা দেখার চেষ্টা করছেন। আমরাও তড়িঘড়ি করে জানলার কাঁচে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাকিয়ে দেখি জঙ্গলের গাছ পাতার মধ্যে থেকে একটা শুঁড় বেরিয়ে আর একজোড়া বড় বড় কান লটপট করছে। আরেকটু খেয়াল করতে দেখি, আরেকজোড়া কান, তারপর আরেকজোড়া। ফিসফিস করে ড্রাইভার সাহেব বললেন, 'আওয়াজ করবেন না একদম, হাতির পাল, ক্ষেপলে আর দেখতে হবে না।' কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে গাড়ি ছাড়ল আর আমরাও ফুন্টসেলিঙের দিকে এগিয়ে চললাম। ভুটানের গেট ক্রস করে বাসস্টপ,রাজবাড়ী, পেট্রল পাম্প পেরিয়ে পাকদন্ডী পথ ধরে এগিয়ে গাড়ি এসে থামল একটা মনাসট্রির ভেতরে।
 হেঁটে বেশ কিছুটা গেলে তবে মনাসট্রির গেট। চারদিকে একটু গলা বাড়িয়ে তাকালেই নীচে গোটা শহরটা দেখা যায়। দেশলাই বাক্সের মতো ছোট ছোট বাড়ি, নীলচে সুতোর মতো নদী একটা। নানা রঙের রোদে ভাজা ভাজা হতে হতে যখন এগোচ্ছি, পেছন থেকে একটা খুব চিকন গলা কানে এলো-'ওমা ওমা, এখান থেকে তো গোটা দুনিয়াটাই দেখা যাচ্ছে।
-গোটা দুনিয়াটা কত বড় তুই জানিস?
-তাহলে গোটা পৃথিবীটাই তো দেখা যাচ্ছে তো।
-গোটা পৃথিবীটাই? তুই গোটা পৃথিবীটার কতটা দেখেছিস রে?
-মা একটা ছবি তোলনা গোটা দুনিয়াটার...'

এরপর আর কী কথা হলো সেটা শোনা হয়নি, কারণ আমিও 'গোটা দুনিয়াটা' দেখার জন্য এগিয়ে গেছিলাম। সময় হাতে বেশি না থাকায় ক্রোকোডাইল পার্কে একটা ঢুঁ মেরেই আমরা এবারকার মতো ড্রাগনের রাজ্যকে টাটা বলে আমরা এদেশে ফেরত এসে চললাম জলদাপাড়ার দিকে। ফের লোকালয়, বাজার সব পেরিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় কিছুটা চলার পর দেখি বড় বড় করে লেখা 'আকাশিয়া লজ- দিস ওয়ে' সাথে একটা বড় তীর চিন্হ। দেখে বেজায় খুশি হয়েছিলাম, কারণ অতক্ষন গাড়ির ব্যাকসিটে বসে কোমর বেশ গিটকিরি দিয়ে খেয়াল গাইতে শুরু করেছে। কিন্তু ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট চলার পরও কিছুতেই লজের দেখা মেলে না। কতক্ষণ পর মনে নেই, গাড়িটা হুট করে একটা বড় গেটের ভেতর দিয়ে একটা  চা বাগানের ভেতর ঢুকে পড়ল। সব দল বেঁধে মহিলারা চা পাতা তুলছেন। আর তার উল্টো দিকেই লজের গেট। ভেতরে ঢুকছি তখন সূর্য্য মধ্যগগনে। ঢুকে দেখি টিভিতে সালমান খান আর রানী মুখার্জির কী একটা সিনেমা চলছে। বোর্ডাররা , ম্যানেজার মায় কর্মচারীরা পর্যন্ত হেব্বি ব্যস্ত তাতে। বেশ কিছুক্ষণ গলা খাঁকরানির পর তাঁরা আমাদের দেখলেন । খুব অনিচ্ছা সহকারে টিভির সামনে থেকে উঠে ঘরের চাবিও দিলেন। বেশ গরম, রোদের তাপে আমরা বিরক্ত হলেও দেখি মা মাসিমনির খুব আনন্দ। অবশেষে জামাকাপড় কাচার সুযোগ পাওয়াতে কেচে কুচে স্যুটকেস খালি করে ফেলেছে অর্ধেক।
দুপুরে বিছানায় শুয়ে গরমে হাঁস ফাঁস করছি হঠাৎ সিলিংয়ের দিকে হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি, কালো লোমওয়ালা কী একটা অদ্ভুত জিনিস পায়চারি করছে। দেখেই চিনেছি। টুলটুলদিদের বাড়ির পেয়ারা গাছে ও জিনিস প্রায়ই আসত, একবার আমার জামার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। আর আমি আল ফোটার  যন্ত্রনায় চিৎকার করে পাড়া মাত করেছিলাম। ঘুম টুম সবার মাথায় উঠল,বেশ কিছুক্ষণ তেনার মাটিতে পড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু হেব্বি স্কিলড ট্রাপিজ আর্টিস্টের মতন তিনি সিলিংয়ে আটকে থাকায় শেষে লোকজনকে  ডাকাডাকি করতেই হোক। ফের বেশকিছুক্ষণ চেঁচামেচির পর ছোটু বলে একজনের আগমন ঘটল।এবং আমাদের ঘাবড়ে যাওয়া চেহারা দেখে সে ফিক করে হেসে কাঠি দিয়ে শুঁয়োপোকাটাকে 'এইটা কোন ব্যাপার নাকি' এরকম ভাব করে টুক  বাইরে বাগানের মধ্যে ছেড়ে দিল। জলদাপাড়ায় এর চেয়ে বেশি এক্সসাইটিং কিছু আর হয়নি। জঙ্গল সাফারিতে দুটো কুনকি হাতি ছাড়া আর কারুর সাথে দেখাও হয় নি।

 জলদাপাড়ার জঙ্গল গরুমারার মতো না। এখানে ঘাসের দখলদারি বেশি। যতদূর চোখ যায় সবটাই প্রায় একমানুষ উঁচু উঁচু ঘাসে ঢাকা। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। ফিরতি পথে কয়েকটা হাতির দেখা পেয়েছিলাম তবে অনেকটা দূর থেকে। রাতে সবাই যখন শুতে চলে গেছে চুপি চুপি বেরিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় গোটা বাগান ভেসে যাচ্ছে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। লজের গেটের ঠিক সামনে কংক্রিটের ওপর জমে থাকা একটা গোদা পায়ের ছাপ। একদিন পরেই কলকাতা, গাছপালা আর খোলা আকাশের বদলে ইঁট কাঠ পাথরের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখতে হবে। মন খারাপ ঠিক না, আগেও দেখেছি, চাঁদ বড় পাজি। মন খারাপের ছোঁয়াচ লাগিয়ে দেয়। অকারণে আজে বাজে কথা ভাবায়। বাবা ডাকাডাকি করায় ভেতরে চলে আসতে বাধ্য হলাম। পর দিন সকালে আমাদের গন্তব্য ছিল খয়েরবাড়ি। যদিও গেট খোলার অনেক আগে পৌঁছে গেছিলাম, কিন্তু আমরা সেদিনই ফিরছি শুনে কর্মচারীরা ঢুকতে দিয়েছিলেন। চা বাগানে ঢুকে পরে ফিরতে না পারা বাঘেদের রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার এটা। 
গেট থেকে নেমে বেশ খানিকটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে একটা কাঠের ব্রিজ পেরোতে হয়। আরো খানিকটা এগোতেই বোঁটকা গন্ধ জানান দিলো তাঁরা কাছেই আছেন। গোটা জায়গাটা বড় বড় জাল দিয়ে ঘেরা প্লটে ভাগ করা। 

আমাদের পাড়ার মেনি ইগলুর বোনপো, বোনঝিদের সাথে আলাপ করে আমরা রওনা হলাম শেষ গন্তব্যের দিকে। চা বাগান, লিলিপুল, লিলিপুলে ফুটে থাকা শাপলা, শাপলা পাতায় বসে থাকা ব্যাঙ আর সব সবুজ-সবাইকে টাটা বাই বাই বলে সব ছাড়িয়ে কুচবিহার অবধি এসে নামা পর্যন্ত আর মন খারাপ হয় নি খুব একটা। বরং কতক্ষনে কলকাতায় ফেরত আসতে পারবো সেই ভেবে লাফাচ্ছিলাম।  কুচবিহার রাজবাড়ী যেকোনো পুরোনো আমলের গ্র্যান্ড স্ট্রাকচারের মতোই ভালো, সুন্দর আর নস্টালজিয়া উস্কে দেওয়া। 
গেট থেকে বেশ খানিকটা হেটে গেলে ঢোকার বারান্দা। মোবাইল ফোন সুইচ অফ করে ভেতরে ঢুকতে হল। ঢুকেই বড় হল একটা। পুরোনো দেয়ালে নতুন রঙের পোঁচ পড়েছে। খাতায় কলমে তাতে 'মেইনটেন্যান্স' হয়েছে বটে তবে সাদা নীলের আধিক্যের চোটে চোখ কট কট করছিল কিছুটা। উপরন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় কাঁচা হাতের কাজে নকশার সূক্ষ্মতা তাতে নষ্ট হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। রাজা রানীর পোট্রেট , নানা স্মৃতি চিন্হ, কিছু আশেপাশে মাটি খুঁড়ে পাওয়া প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন আর হালকা সুরে বাজা রবীন্দ্রসংগীতের সান্নিধ্য ছেড়ে শেষ বিকেলে যখন ট্রেনে উঠছি, তখন বোধহয় অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ প্রেমিকের মতো ডুয়ার্সকে মনের পেছনে ঠেলে দিয়েছি, ট্রেনের সিট পাওয়া, কলকাতায় এসে কী করব, ফাইনালি ফোনের নেটওয়ার্ক পাবো এই সমস্ত ভাবনার পেছনে। ডুয়ার্স বোধহয় মুচকি হেসেছিল সেটা দেখে।
৮. 'জুলফি কার????'
সারারাত ট্রেনে কাটিয়ে হাওড়া ঢুকতেই টের পেলাম এতদিন পরিষেবা সীমার বাইরে থাকার পর আমার মুঠোফোনটি আচমকা জেগে উঠেছেন।
বিজয়া, লক্ষীপুজো, রোজকার গালগল্প ইত্যাদির চাপে তিনি কেঁপে টেপে অস্থির।
বেড়াতে যাওয়ার আগে থেকেই সৃজিত মুখুজ্জের জুলফিকার দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। বিকেলে বেড়িনোর সময় টের পেলাম বিছানা ছেড়ে উঠতে বেজায় মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু ওই যে, হুজুগ উঠলে যা হয়, রাজকাহিনী দেখার দুঃসাহসের পর ফের নবীনা সিনেমাহলের রেসিডেন্ট ছারপোকার কামড় খেতে খেতে আমি সিনেমাটা দেখেও ফেললাম। ১০০ টাকা টিকিট-আমি তাতে রেস্টুরেন্টে খেতে পারতাম, একটা গোটা বাক্স চকোলেট কিনতে পারতাম, দুটো ভালো তুলি হয়ে যেত, একবক্স ফেল্টটিপ পেন কিনতে পারতাম, কিন্তু তা না করে আমি সৃজিতের জুলফি খুঁজতে গেলাম। এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই ট্রমা না নিতে পেরে আমি সন্ধ্যে থেকে জ্বরে পড়লাম। মুখুজ্জে মশায়ের খুরে খুরে দন্ডবত! মানে এই ধরণের সিনেমা একশ দুশো বছরে একবারই তৈরি হয় আর আমার মতো ভয়ানক কপাল হলে তবেই দেখতে পাওয়া যায় আর কী। জ্বরের ঘরে ওনাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু বেশ কয়েকবার সাদা প্রজাপতি, রেলব্রিজ, আর জঙ্গলে ঘুরে এসেছি বটে।
৯. 'এপিলগ'
আমার ডুয়ার্সের গল্প এখানেই শেষ যদিও। গত কয়েক মাসে যতবার মন খারাপ হয়েছে, স্বার্থপরের  মতো চোখবুজে আমি  ডুয়ার্সের কাছে ফিরে গেছি,   সবুজে ঘেরা পাহাড়, ঠন ঠন গাড়ি চলা নদীর ওপরের লোহার ব্রিজের দেশে। আমি যাওয়ার আগে অবধি ভাবছিলাম মায়েদের ছোটবেলার জায়গা, দিদার গল্পের ডুয়ার্স যাব, দেখব। সেই সমস্ত টুকুকে ছাপিয়ে ডুয়ার্স যে কখন আমার হয়ে গেছে, তাকে নিয়ে যে আমার পসিসিভনেস,(খানিকটা দুঃসাহস করে বললে নিজস্ব ন্যারেটিভও বটে)  তৈরী হয়েছে সেটা পরে বুঝেছি। আর শেষদিন দুচ্ছাই করেছি বলে নিজের ওপর রাগও হয়েছে। তবে চুপিচুপি বলে রাখি, আমি কিন্তু মনের মধ্যে কুয়াশা ঘেরা জলঢাকাকে লুকিয়ে রেখেছি। যখন ইচ্ছে ফিস ফিস করে তাকে ডেকে নেব।
-------------
বাকি মুহূর্তগুলোকে এখানে খানিকটা রইল আর কী...




                                         ...............ক্রোকোডাইল পার্কের সব বুন্ধু বান্ধব.................. 





                                                           ..................বাই বাই ডুয়ারস.....................

Comments

  1. আমার মেয়ে বলে বলছিনা সত্যি ই লেখা টা ভীষণ ভালো হয়েছে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সূচনা,নামকরণ এবং ইত্যাদি

পরশ পাথর

বুক-টুক