পরিচিতি

জগতের যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ খুব সম্ভবত নিজের ইন্ট্রোডাকশান দেওয়া। আমি কে , আমি কী এর উত্তর দেওয়ার থেকে কঠিন কাজ নেই। আমার এই পুঁচকে ব্লগের বয়স খুব বেশিদিন না  এবং আদৌ কেউ এই ব্লগ পড়ে কিনা সে নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে , তাও  নিজের পরিচিতিটা দেওয়া উচিত, তা সে যত কঠিন কাজ ই হোক না কেন।  তাহলে শুরু করা যাক...... আমার নামঃ  -আমার ভাল নাম সেঁজুতি , ইংরিজিতে বানান বিভ্রাটে বেশির ভাগ লোকের কাছে আমি সেঞ্জুতি  , তাই আমার ডাক নামটা আমার বেশি পছন্দের, সেটা হোল ঝিল্লী, এই নামটা আমার দিদার দেওয়া। ট্যাঁ ট্যাঁ  করে সারাদিন চিৎকার করতাম বলে হয়ত।  আমি কী করি? -এটার উত্তর দেওয়া সবচাইতে সহজ। আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। আমার বয়স কত? - আমার জন্ম নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। বাকিটা আর বললাম না।  আমার ঠিকানা -কেন এই তো - http://choshmaebongityadi.blogspot.in  তবে আমি যেখানে 'থাকি' সে জায়গাটা হোল কোলকাতা। রিলেশানশিপ স্ট্যাটাস   - টারমিনালি সিঙ্গেল  রিলিজিয়াস ভিউস   - কি সব্বনাশের প্রশ্ন !  আমার কী ভালো লাগে? -হেহ! সুপার হিরো কমিক্স (বিশেষত হারলি কুইন এ

জুঁই, রজনীগন্ধা আর বৈশাখ

---এসো হে---
বাসের এসি টা খারাপ। হুস হুস করে ঠান্ডা হাওয়া মাথায় লাগে কট কট করে আর এদিকে কালচে কাঁচের ওপাশে রোদে জ্বলে যাওয়া জংলি ফুল দেখে বোঝা যায় বোশেখ এসেছে।
'না না, হেল্প লাগবে না, এমনিই একটু ঘুরে দেখছি'র উইন্ডো শপিংয়ের আড়ালে এসির হাওয়া খাওয়ার ছুতোয় বোশেখ এসেছে। 'নিয়ে যান দিদি, চৈত্র সেল....সব হাফ দামে'র তাগাদায় এসেছে। পয়লা বৈশাখের সেলফিতে এসেছে আর আমাদের বাড়িতে এসেছে রজনীগন্ধার গন্ধে।
পয়লা বৈশাখ এলে মন টন বড্ড খারাপ হয়।ঐ দিনই বুড়ি ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল কিনা। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে, সেটা রোদের তাপে না বুড়ির ওপর রাগে ঠিক জানিনা। দিদা রজনীগন্ধার গন্ধ সহ্য করতে পারতো না। বলতো মরা মানুষের গন্ধ। আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগতো না, দিব্যি মিষ্টি মিষ্টি, খারাপ কী। ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে মানে ছিল দিদার হাতের পাঁঠা রান্নার গন্ধে আগে আগে খিদে পেয়ে যাওয়া,দোকানে রজনীগন্ধা, নতুন জামা আর ঘাড়ে হাতে ছোপ ছোপ পন্ডস পাউডার লাগিয়ে বিকেলে মা আর দিদার সাথে যতন মামার দোকানে হাল খাতা করতে যাওয়া। আরেকটা জিনিস হতো, প্রভাতফেরী। আমাদের পাড়ায় একটা মাতৃভাষা রক্ষা সমিতি ছিল একটা। পয়লা বৈশাখে আর ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বাঁধা ছিল সকালে একটা ম্যাটাডোর, তাতে একটা মাইক, একটা ভাড়া করা হারমোনিয়াম আর তবলা, আর যারা গান গাইতে জানে তাদের বসার জায়গা। আমরা বাকিরা শাড়ী পরে লটপট করতে করতে নাচতে নাচতে রাস্তা দিয়ে যেতাম। 'এসো হে বৈশাখ' আর 'এদিন আজি'টা কমন ছিল, ফেরার পথে বিচ্ছিরি রকম রোদ উঠে যেত আর আমরা জলের তেষ্টায় হাঁক পাঁক করতে করতে ম্যাটাডোরের পেছন পেছন চলতাম। পাড়ার সরকারি প্রাইমারি স্কুলটায় সকাল বিকেল মহড়া চলত, ধুলো ভর্তি ঘরে লাফালাফিতে আসল দিনের আগে সবার নাক ফিচফিচ। সমিতিটা উঠে গেছে, স্কুলটা অনেকদিন আগেই গেছিল। এখন সন্ধ্যে বেলায় ঘরগুলো অন্ধকার থাকলেও ভেতর থেকে ফিসফাস আওয়াজ পাওয়া যায় ঠিক। ফেরার পথে ঘরটার পাশ দিয়ে ফেরার সময় হাঁটার স্পিড বাড়িয়ে দিই খালি।
তাই এবছর আবার যখন প্রভাতফেরীর কথা উঠলো, সেটা শুনে মনের ভেতরটায় ডুগ ডুগ করে উঠেছিল।
একসপ্তাহ ধুলো ভর্তি ক্লাবে মহড়ার পর উত্তেজনায় আধঘুমে রাত পার করেই পরদিন সকালে দে ছুট। তাড়াহুড়ো করে পরা শাড়ি আর মাথায় জুঁই ফুলের মালা। জুঁই বড্ড প্রিয় ফুল আমার। গোলাপের মত শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে না, তবে বুকের মধ্যে একটা ঠান্ডা হাওয়া লাগিয়ে দিয়ে যায়।
------চল রে নওজোয়ান----
এর পরে যা হওয়ার  নিয়ম ধরে তাই তাই হল, আমরা নাচতে গাইতে স্লোগান দিতে দিতে এগোলাম, অন্য লোকের গানের আওয়াজে আমাদের গান আর আমাদের গানের গুঁতোয় তাঁদের গান চাপা পরল, দুপক্ষই ক্ষেপলো তারপর নিজেদের ব্যবহারে নিজেরাই এহে! এটা কী করলাম জাতীয় কেস হল, এবং আমাদের রোদে গাল হাত পুড়লো, নাচের স্টেপ না মেলায় বকুনি জুটলো, পাশে হাঁটা কাকিমা আমার শাড়ি পা দিয়ে মাড়িয়ে জ্বলজ্বলে ছাপ দিলেন আর তার কিছুক্ষণ পর বেখেয়ালে মৌলির কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে গোটা রাস্তা 'রেস্পেক্টাবল ডিস্টেন্স'মেন্টেন করলেন, গোটা রাস্তা পেরিয়ে আমি টের পেলাম যে কপালের মাঝের বদলে কোন এক কোণায় টিপ নিয়ে আমি গোটা রাস্তা হেঁটেছি। আর কেউ সেটা দেখেও নি। ঘর শত্রু বিভীষণ বলে টলে গালাগাল দিতে গেছিলাম সবাই এমন খিল্লি শুরু করল যে আচ্ছা দাঁড়াও! আমারও আসবে দিন ভেবে টেবে চুপ করে গেলাম। তারপর এক গাদা ছবি, তেষ্টায় কাঠ হওয়া গলা আর ফিচিক ফিচিক হাসি নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম।
-----একলা বৈশাখ এবং পুরোনো কাসুন্দি----
একটা মানুষ চলে গেলে যারা রয়ে যায় তাদের হয় মহা জ্বালা। এক তো ভালো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে না সহজে, খারাপগুলোই ভীড় করে থাকে আর ভালো যাও বা ছিল সেটাও মন খারাপের পরতে ঢাকা পড়ে যায়। দিদার সামনের দুটো দাঁতে একটা স্টিলের ক্লিপ লাগানো ছিল। তোবড়ানো গাল নিয়ে হাসলে ক্লিপটায় আলো পরে চিক চিক করত। চলে যাওয়ার পর কিছুতেই হাসি মুখটা মনে পড়ত না, খালি শেষ কয়েক মিনিটের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখটাই ভেসে আসতো। কয়েক বছরে তাই 'দিদা'র ছবিটা আবছা হয়ে আসছিল, দিদার চুলের সিঁথির ভাঁজ, গায়ের গন্ধ, 'ধুর ধুর ধুর' বলা সবটাই- খুব মন দিয়ে চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করতাম, দিদাকে, হাসি হাসি মুখ করা ফোকলা দিদাকে -এই ধরে ফেললাম ধরে ফেললাম, হাতের লাল তিলটাও যেন নাগালের মধ্যে এসে যেত, তারপরই ভ্যানিশ। বর্ষাকালের পাহাড়ের মেঘ যেন। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে ভেজা ছাপটুকু রেখে উধাও হয়ে যায়। প্রথম প্রথম মন খারাপ হতো, তারপর ঐ...যা হয় আর কী। ফর্সা দাদু মারা যাওয়ার পর দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-'মনে' পড়ে কিনা।
এখন জানি, পড়ে, রোজ।
পয়লা বৈশাখ কাটলো আমার তাই ছবির অ্যালবাম উল্টে, আর ফটির গল্প, ঘাটালের গল্প মনে করে। কারণ হাসিমুখ তোবাড়ানো গাল আর দাঁতের ক্লিপ চিক চিক করা মানুষটাই দিদা। বাকিটা নয়।
ও হ্যাঁ, রজনীগন্ধা আর ভালো লাগে না আমার কেন জানি না।

Comments

  1. বেশ.. অনেক কটা শেড রয়েছে.. আর খুশির ব্যাপার আলাদা ভাবে আইডেন্টিফাই করা যাচ্ছে না.. মিলে ঝুলে ছবিটাকে বেশ এঁকেছে...
    লেখিকা ছবিও আঁকছে বেশ..আশা রইলো দাবী রইলো ক্যানভাসের আরও বৃহত্তর হওয়ার.
    ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. মানছি যে যাতা জিনিসে ট্যাগ করছি, কিন্তু তাই বলে লেখিকা ফেকিকা বলে চাটবি! ধম্মে সইবে না!

      ওগো তুমি এটা করতে পারলে গোওওওওও!!!!!!!!!!! *ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রবল বেগে ক্রন্দন এবং হাহাকার*

      Delete
  2. আসলে সোশ্যালি খিস্তি দিতে কেমন একটা ইয়ে ইয়ে লাগছে বালইকা...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি তোকে সেইভাবে খিস্তি দিতে দেখিনি কিন্তু কোনোদিনই। সোশ্যাল আনসোশ্যাল কোনো ক্ষেত্রেই।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সূচনা,নামকরণ এবং ইত্যাদি

পরশ পাথর

বুক-টুক